ফারহানা নীলা :
নেকড়ে বাঘ এলে এক বন্ধু গাছের উপর উঠে গেলো। আরেক বন্ধু গাছে উঠতে পারে না। মাটিতে মরার মত পড়ে থাকলো। নেকড়েটা গন্ধ শুঁকে চলে গেলো। গাছ থেকে নেমে সেই বন্ধু জানতে চাইলো… নেকড়েবাঘ তোর কানে কানে কি বলে গেলো?
গল্পটা ছোটবেলায় বোধ হয় অনেকেই পড়েছি।
যারা ঘরে আবদ্ধ ছিলেন, তারা এখন রাস্তায় এসে জিজ্ঞেস করার সময়… করোনা কি বলে গেলো?
বিষয়টি অবশ্য উল্টো। ঘরে থাকার কথাই ছিল আমাদের। রাস্তায় কেন গেলাম তবে?
এখন আর ঘরের সময় নয়। বের হতেই হবে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কাজ করতে হবে। ব্যবসা বাণিজ্য সব চলবে। দোকানপাট, মার্কেট… সব খোলা। খুলে যাবে গণপরিবহন, ট্রেন, প্লেন সব। যদিও সবই সীমিত পরিসরে!
সীমিত পরিসরে কথাটা আমরা কয়জন বোধে নিতে পেরেছি? অথবা কয়জন মানতে পারবো?
আমাদের আর বসে থাকার উপায় নেই। লাফিয়ে লাফিয়ে করোনা এগিয়ে আসলে মরার মত শুয়ে পড়ার জায়গাও নেই। গতিশীলতা আনতেই হবে। আজ ২৫২৩ জন আক্রান্ত, মৃত ২৩ জন। আগামীকাল তিন হাজার হয়ে যাবে হয়তোবা।
একটা ফোনে নতুন আক্রান্ত রোগীর কথা জানলাম। তিনি ঘরে আইসোলেশনে আজ থেকে। ঘরের ভেতর থেকে আইভারমেকটিন, ডক্সিসাইক্লিন, জিংক আর ভিটামিন সি কেনার জন্য পরিবারকে বলেছেন। কথাটা ভালভাবে নেবো নাকি খারাপ ভাবে নেবো বুঝে আসে না। তবে এটুকু বুঝতে কষ্ট হয় না যে, এখন ঘরে ঘরে হাসপাতাল গড়ে তোলার সময়।
বাইরে বের হতেই যখন হবে,তখন নিজের দায়িত্বও নিজেকেই নিতে হবে। অনির্দিষ্টকালের জন্য ঘরে থাকাও আর যাবে না।
আজ থেকেই প্রস্তুতি শুরু করা প্রয়োজন।
নিউ নর্মাল লাইফ… কথাটিকে মাথায় নিতে হবে। আগেরকার মত সময় নয় এটা।
কেমন হবে সেই প্রস্তুতি?
১. মাস্ক আবশ্যক। অন্ততপক্ষে পাঁচটি মাস্ক। প্রথম দিন যেটা পরবেন,সেটা আবার পঞ্চম দিন। একটি পলিথিনে মুড়ে পাঁচ দিন রেখে দিন।
২. ঘড়ি, ওয়ালেট, পার্স, ব্যাগ, আংটি, চুড়ি, দুল, মালা…. আপাতত ব্যবহার না করাই ভাল। আর করলেও স্যানিটাইজ করুন।
৩. গ্লাভস সবার দরকার নেই। সারাক্ষণ এক গ্লাভস পরে আপনার ফলস সিকিউরিটি মনে হতে পারে। ঐ হাত নাক,মুখ,চোখে লাগলে সর্বনাশ। কোনো কিছু ধরলে হাত সাবানে ধুয়ে নিন অথবা স্যানিটাইজ করুন।
৪. অফিসের টেবিলের চেয়ারগুলো দূরত্বে রাখুন। তিন ফুট থেকে ছয় ফুট। একই রুমে অনেকজন বসলে টেবিলের অবস্থান এমন ভাবে করুন যেন মুখোমুখি না বসেন।
৫. অনর্থক নিজের কাজের জায়গা থেকে অন্য কোথাও যাবেন না। কথা বলার সময় ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলুন।
৬. খাবার বাসার থেকে নিয়ে যান। নিজের কাপ,গ্লাস নিয়ে যান। নিজেই সেগুলো ব্যবহার ও পরিষ্কার করুন।
৭. মাথায় ক্যাপ, কাপড়, ওড়না, টুপি ব্যবহার করুন। চুলও সাবধানে রাখতে হবে। কারণ চুল নাক, মুখ আর চোখের খুব কাছাকাছি থাকে।
৮. চোখে সানগ্লাস বা চশমা ব্যবহার করুন। বাসায় ফিরে স্যানিটাইজ বা ধুয়ে ফেলুন।
৯. জুতা, স্যান্ডেল পাঁচ জোড়া হলে মাস্কের মত একই নিয়মে ব্যবহার করুন। আর পানি লাগানো যায় এমন স্যান্ডেল হলে ধুয়ে নিন।
১০. যাতায়াতের জন্য হাঁটা উত্তম। রিকশা, সিএনজি এসবে উঠলে নেমেই হাত ধুয়ে নিন।
১১. নিজেকে বারবার সাবধান করুন।
১২. বাসায় ফিরে সোজা গোসলে যান। কাপড়চোপড় সাবানের পানিতে ভিজিয়ে রাখুন।
১৩. কত কম জিনিস ব্যবহার করে জীবন চালানো যায়… সেটা রপ্ত করুন।
আরো হয়তো অনেক কিছুই আছে। নিজেদের নিজেরা সুরক্ষিত করুন।
স্কুল,কলেজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন খুলছে না। বাচ্চাদের এই সব নিয়ম মানানো কঠিন। তারা তো এত কিছু বোঝে না। ওরা ঘরেই থাকুক। আমরা ১৯৭১ সাল দেখেছি। তেমন সময় মিলিয়ে কিছু মনে করতে পারি না।ছোট ছিলাম তখন। কিন্তু তখন লেখাপড়া নিয়ে কেউ ব্যতিব্যস্ত হয়নি। মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা।
এখন আমাদের মূল লক্ষ্য বেঁচে থাকা,সুস্থ থাকা।
‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা,সব শিশুরই অন্তরে’— আমাদের প্রজন্মের জন্য আমরা সুরক্ষার উপায় খুঁজি। ওদের মনোজগতের খোঁজ রাখি। ঘরে থেকেই ওরা লেখাপড়া করুক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেপ্টেম্বরে খোলার কথা বলেছেন। আশায় থাকি ততদিনে কেটে যাক মেঘ। আলো ঝলমলে দিনে আমাদের শিশুরা, আমাদের প্রজন্মরা নির্ভাবনার পৃথিবীতে হেসে উঠুক কলকলিয়ে।
জীবনের কাছে আমাদের অনেক ঋণ আছে। ঋণ আছে বেঁচে থাকার কাছে। কিছু ঋণ থাকুক না হয় আরো কতদিন!
ভয় পান বেশী, বেশী। আতংকিত আর শংকিত হোন বেশী, বেশী। তবেই আসবে সচেতনতা। আর আসবে সুরক্ষা। ভয় না পেলে মানুষ সচেতন হয় না। আগুনের আঁচ না লাগলে কেউ বোঝে না পোড়ার জ্বালা।
ভয়, আতংক, শংঙ্কা… এসবের প্রয়োজন সচেতনতার জন্য। কিন্তু উদ্ভ্রান্ত হবার জন্য নয়। উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ করলে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনবেন… কথাটি কিন্তু ভুল নয়।
মাথা ঠাণ্ডা রেখে এখন মোকাবিলা করার সময়। পালিয়ে যাবার কোনো পথ নেই।
পিছিয়ে যাবারও পথ খোলা নেই।
তাই আগে বাড়ো…. আগে বাড়ো!
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল।