ডা. পলাশ বসু :
বহু বছর আগে পাবলিক পরীক্ষা মানেই তার শুরুটা হতো এসএসসি থেকে। তখন ফলাফল হতো ‘ডিভিশন’ নামক সোনার হরিণের খাঁচায় বন্দী হয়ে। সাথে ছিলো ‘স্টার’ আর ‘স্ট্যান্ড’। রেজাল্টের পরে পত্রিকার পাতজুড়ে থাকতে এই স্ট্যান্ডধারীদের খবর, সাক্ষাৎকার। তাদের গর্বিত বাবা-মায়ের সাক্ষাৎকারও থাকতো। এর সাথে আবার পুরো বাংলাদেশে কে কোন বিভাগে (বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য) ফার্স্ট, সেকেন্ড হতো মিলতো তারও খবর।
সে দিন অবশ্য বাসি হয়েছে। এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে ডিভিশান ইতিহাসে বন্দী। কারণ এখন রেজাল্ট হয় জিপিএ এর ভিত্তিতে। তাই গোল্ডেন জিপিএ, জিপিএ পাঁচ এসবের খবর হয়। আর সোশ্যাল মিডিয়াও এ নিয়ে থাকে বেশ সরগরম।
পাবলিক পরীক্ষা এখন বস্তুত শুরু হয় পঞ্চম শ্রেণী থেকে। তারপর অষ্টম শ্রেণীতে অনুষ্ঠিত হয় আর একটি পাবলিক পরীক্ষা। যদিও আজ অবধি এ দুটো পরীক্ষার বস্তুগত লাভালাভের বিষয় আমাদের কাছে অজানাই রয়ে গেছে। ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে এ দুটো পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কোন সুপারিশ কিন্তু ছিলো না। তাহলে যা নেই ‘শিক্ষানীতি’তে তা কিভাবে ঢুকে গেলো আমাদের ‘রাষ্ট্রীয়নীতি’তে? এর উত্তর কারো জানা থাকলে থাকতেও পারে; অবশ্য আমার তা জানা নেই।
এই যে জিপিএ কেন্দ্রিক একটা সময় চলছে এটা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে নানা কথা আছে। অনেকের মনেই এ প্রশ্ন আছে যে আমরা এখন যতটা রেজাল্টভিত্তিক পড়াশুনায় তালিম নিচ্ছি ততটা কি নৈতিকতা, মানবিকতা এবং দেশপ্রেমের শিক্ষা পাচ্ছি? অন্যকে মাড়িয়ে, ঠেলে, ধাক্কায় পেছনে ফেলে নিজেকে সামনে এগিয়ে নেয়ার অন্যায্য, অনৈতিকতা আমরা ছোটদেরকে যে শিক্ষা দিচ্ছি – তারও পরিণতি কিন্তু সুখকর নয়। কারণ, এই যে যেনতেন প্রকারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার মানসিকতা এটা যে বিকৃতরুচির পরিচায়ক হয়ে উঠবে একসময়-তা মোটামুটিভাবে অনুমান করা যায়। এসব ছেলে-মেয়েদের অনেকেই হয়ত তার চেয়ারের চেয়ে ব্যক্তিগতক্ষমতা দেখাতে উদগ্রীব হয়ে উঠবে। ভোগবাদী মানসিকতাকে পুঁজি করে রাষ্ট্রযন্ত্রকে তার সুযোগ সুবিধা নেয়ার হাতিয়ার করে তুলবে। রাষ্ট্রের সেবা করার মানসিকতা হয়ত এদের তৈরি হবে না কখনোই।
সারাবিশ্ব এখন অস্থির সময় পার করছে। করোনাকালের কঠিন সময় আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। এটাকে মোকাবেলা করতে গিয়ে এখন আমরা আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা যথাযথভাবে গড়ে না তোলার যে পরিণতি তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। যারা একটু সর্দি কাশি হলেই বিদেশ ছুটতেন চেক আপের জন্য তারা এখন কোথায় যাবেন? পারছেন কি বিদেশ যেতে? টাকা তো অনেক আছে। সময়ে কি তা কাজে লাগছ?অথচ তারা চাইলে খুব ভালোকরেই গড়ে তুলতে পারতেন আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা। ছেলেমেয়েদরকে বিদেশে না পাঠিয়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নততর করার দিকে মনোযোগী হতে পারতেন। দেখা যাক, করোনাকাল চলে গেলে তাদের আত্ম উপলব্ধিটা ঠিক থাকে কিনা!নাকি চাটার্ড বিমানে দেশত্যাগ করেন!
এই বাস্তবতায় তাই আগামী প্রজন্মের জন্য এই ভোগবাদীদেরকে ভাবতে হবে- ঘর ঠিক না করে আর কতদিন পরের কাছে যাবেন? ক্যাশ, ক্রাইম আর করাপশানকে আর কতদিন জিইয়ে রেখে দেশকে ফোকলা করবেন? এসব ব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টাতে হলে রাজনীতিতে গুনগত পরিবর্তনের পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থা যেন শিক্ষার্থী বা বিদ্যার্থী তৈরি করতে পারে; মানবতাবাদী, দেশপ্রেমিক মানুষ গড়ার কারখানা হয়ে উঠতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখাটা সবার আগে জরুরি। আর বাজেটেও তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ মৌলিক প্রয়োজনের অন্য অনুসঙ্গে বরাদ্দ দিতে হবে বেশি বেশি।
বর্তমানে একটা কঠিন পরিস্থিতিতে নবীনরা তাদের এসএসসির ফল পেলো। তোমাদের সামনে পড়ে আছে বৃহত্তর জীবনের হাতছানি। নিজেকে মেলে ধরার সেই বিস্তৃত কর্মক্ষেত্রে তোমরা সফল হয়ে উঠবে, একজন সত্যিকারের মানবতাবাদী, দেশদরদী মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে- আজকের দিনে সেই প্রত্যাশা রইলো তোমাদের কাছে। সেই সাথে রইলো আন্তরিক অভিনন্দন। আর তোমরা যারা খারাপ করেছ তারা সামনে ভালো করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হও। তোমাদের সাফল্যে তুমি একা নও; পুরো দেশ যেন আলেকিত হয়ে ওঠে তেমন করে জীবনকে সাজাও। নিজেকে অনুপ্রাণিত করে তোলো।
করোনাকালের এই আঁধার কেটে আবার আলোক শিখা জ্বলে উঠুক-সেই প্রত্যাশায় তোমাদেরকে আবারো অভিনন্দন।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।