ডা. পলাশ বসু :
আমরা মানুষ। আমরা সৃষ্টিকর্তার দোহাই দিয়ে বলছি যে আমরা নাকি সৃষ্টির সেরা! তাবৎ জীবকুলের শ্রেষ্ঠ! সে তো খুবই ভালো কথা। মিষ্টি কথা। কিন্তু এ কথায় যতটা মধু আছে ততটা না হয় বাদ দিলাম। আমাদের কাজ-কর্ম দেখে কি আপনার মনে কখনই এতটুকু সন্দেহ হয় না, সত্যিই আমরা শ্রেষ্ঠ কিনা? নাকি আমরা যা কিছুই করি না কেন তাই শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে থাকি?
করোনাকালের এ দুঃসময়ে বিশ্বব্যাপী আমরা মানুষেরাই কিন্তু বিপদে পড়েছি। অন্য কোনো প্রাণী কিন্ত এই বিপদে পড়েনি। অনেকেই তাই আশা করেছিলেন এবার হয়ত মানুষের সত্যিকারের বিবেক ফিরে আসবে। ফিরে আসবে সম্বিত। বুকভরে শ্বাস নিতে গিয়ে অন্তত নিজেদের নিরন্তর করে চলা অপরাধের ঘানিটা একটু হলেও নামিয়ে রেখে সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠার তালিম নিতে শুরু করবে।
কিন্তু কোথায় কী! আমরা মনে হয় একবিন্দুও পরিবর্তিত হইনি। আমাদের চিন্তার বৈকল্য, কাজের নীচুতা, বিবেকের পশুত্ব সবকিছুই প্রকাশিত হয়ে চলেছে পূর্বের মতোই। বরং করোনাকালে তা মনে হয় অনেক জায়গায় একটু বেশিই দৃশ্যমান হচ্ছে। যেমন- এই সময়ে মাস্ক, গ্লাভস, স্যানিটাইজার, হেক্সিসলজাতীয় হাত পরিষ্কার করার জীবাণুনাশকের কথাই না হয় ধরুন। এখন এগুলোর স্বাভাবিকভাবেই চাহিদা বেড়েছে। অথচ শুরুতেই কোম্পানী আর বিক্রেতারা মিলে এগুলোর কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে বিস্তর টাকা কামিয়ে নিলো। আবার আমরা যারা ক্রেতা তাদের অনেককে দেখা গেলো পারলে প্রয়োজনীয় জিনিস সব একাই কিনে নিয়ে চলে আসে। আর কারো কথা ভাবার সময় আমাদের নেই। ভাবখানা এমন যেন- মরলে অন্য সবাই মরুক তবু বাঁচলে হতে হলে আমি একাই বেঁচে থাকবো। এগুলোকে কি বলবেন? বিবেকের উৎকর্ষতা নাকি বিবেকের নোংরামি?
এর সাথে সাথে গণমাধ্যমে যখন যে ওষুধের নাম আমরা পেয়েছি বা সোশ্যাল মিডিয়া দেখেছি তাড়াতাড়ি তা কিনতে ছুটে গেছি ওষুধের দোকানে। আর মুড়ি মুড়কির মতো কিনে তা খেতে শুরু করেছি। অথচ এ ওষুধের অনেকগুলো কিন্তু চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি করারই কথা না। হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন, আইভারম্যাকটিন, এজিথ্রোমাইসিন, ডক্সিসাইক্লিন আর হালের স্টেরয়েড ওষুধ- ডেক্সামিথাসন সবই আমরা মন মতো কিনে খাচ্ছি। মার্কেটে নাকি সংকট হয়ে গেছে এ ওষুধের! অথচ প্রেসক্রিপশন ছাড়া তো এসব ওষুধ বেঁচার কথা না! তাহলে সংকট হয় কিভাবে? তার মানে আমরা যারা বিক্রেতা তারা কোন আইনের তোয়াক্কা করি না। আর ক্রেতারা আমরা সবাই এক একজন বিশিষ্ট ডাক্তার! যেন ওষুধের নাম জানলে নিজের চিকিৎসা নিজেই করে ফেলতে পারি! নাগরিক হিসেবে কোনরকম দায়-দায়িত্ব বলে কিছু কি নেই আমাদের? যদি থাকে তাহলে তা পালনের বিন্দুমাত্র চেষ্টা করি না কেন আমরা?
আমরা আসলে একটা জিনিসই ভালোমতো চিনি। আর তা হচ্ছে ‘টাকা’। অবৈধভাবে বিক্রি থেকে শুরু করে বেশি দামে বেঁচার আশায় গুদামজাত করা- সবই আমরা করতে পারি বিনা দ্বিধায়। এই আমি ক্রেতা হলে মনে মনে বিক্রেতাকে গালি দিই। আর বিক্রেতা হলেই লাভ আর লোভের জিহ্বা চকচক করে ওঠে। এই যে আমাদের রূপের ভিন্নতা একে কী বলবেন? চিন্তার সততা নাকি চিন্তার বৈকল্য?
সম্প্রতি তো খুলনাতে ঘটে গেলো নৃশংস হত্যাকান্ড। ডা. রাকিব নামের একজন বয়োজ্যেষ্ঠ চিকিৎসক কে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। তাকে তার এলাকার লোকে নাকি বলে ‘গরীবের ডাক্তার’। তাহলে অপরাধ কি ছিলো তার? এই করোনাকালে তিনি ক্লিনিক চালু রেখে রোগীদের সেবা দেয়ার চেষ্টা করেছেন সেটাই কি অপরাধ ছিলো? সেদিন কি ঘটেছিলো আসলে? জানা গেছে ডা. রাকিব সাহেবের পরিচালিত ক্লিনিকে সিজার করে সন্তান প্রসবের বেশ কিছু সময় পরে থেকে একজন মায়ের রক্তপাত শুরু হয়েছিল। ক্লিনিকে তা বন্ধ না করতে পেরে প্রথমে অসুস্থ মা’কে খুলনা মেডিকেলে পাঠানো হয়েছিল। পরে সেখান থেকে ঢাকা পাঠানোর পথে ওনার মৃত্যু হয়। অথচ এই সিজার কিন্তু ডা. রাকিব করেন নি। করেছেন অন্য চিকিৎসক।
অনেকে মনে করতে পারেন (আমরা বাঙালিরা অনেক বেশি জাজমেন্টাল! শুধুমাত্র নিজের কুকাজের বিচারটা বাদে আর সব করতে পারি।) এই রক্তপাত তাহলে ঠিকঠাক সেলাই না করার জন্যই হয়েছে! আসলে তা কিন্তু নয়। কিছু কিছু মায়েদের ক্ষেত্রে দেখা যায়-কী নরমাল ডেলিভারী আর কী সিজার- যেভাবেই সন্তান প্রসব করুক না কেন পরে দেখা যায় রক্তক্ষরণ বন্ধ হতে চায় না। একে বলে- ‘প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ’। অনেক সময়ই এর কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে ‘চিকিৎসকের ভুলে রোগীর মৃত্যু’ এ তত্ত্ব এখানে কাজ করে না। তারপরেও যদি আমরা ধরে নিই- চিকিৎসকের ভুলেই ওই মায়ের মৃত্যু হয়েছে তাহলেও কি আপনাকে এই লাইসেন্স দেয়া হইছে যে, আপনি সাঙ্গপাঙ্গ এনে ওই চিকিৎসককে খুন করতে পারেন? তাকে আঘাত করতে করতে মেরে ফেলতে পারেন? বলুন পারেন কি? যদি না পারেন তাহলে এই মহাদুর্যোগে ক্লিনিকে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে গিয়ে হত্যা করা কিসের আলামত বহন করে বলুন তো? এটা কি ক্ষমতার দাপট নাকি বিবেকহীন পিশাচের কাজ?
এসব দেখে শুনে মনে হয় আমরা সত্যিই এখনো মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি। ফলে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আমাদের কিসের এত আত্মতুষ্টি? পশুরও একটা ধর্ম আছে। দেখবেন, অহেতুক ওরা কোন শিকার ধরে না। অন্য কোন পশু বা মানুষকে বিনা কারণে আক্রমণও করে না। কিন্তু আমরা মানুষেরা? আমাদের কি এই বোধটুকু আছে? আমাদের কাজকর্ম দেখলে মাঝেমধ্যে তো মনেই হয় না। বরং উল্টোটাই মনে হয়- আমরা হয়তো পশুর চেয়েও অধম।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।