কাকন রেজা :
১ জুলাই। আজ ফাগুনের জন্মদিন। ওর তেইশ বছর পূর্ণ হলো। দু’বছর ধরে ওকে ছাড়া জন্মদিন পালন করেছি। এবার নিয়ে তিন বছর। ২০১৮ তে ওর অফিসের কাজের জন্য একসাথে করা হয়নি। ২০১৯ ও চলে গেলো আমাদের ছেড়ে, তাই এক সাথে করা হয়নি। এবারও ও নেই তাই এক সাথে করা হবে না। আর কখনোই হবে না। ওকে ছাড়াই ফি বছর জন্মদিন আসবে, আমরা যতদিন আছি পালন করে যাবো। শুভ জন্মদিন বাবা। শুভ জন্মদিন ইহসান ইবনে রেজা, ফাগুন। যাকে চিনতো সবাই ফাগুন রেজা নামেই। সৎ, মেধাবী, নির্ভিক এক গণমাধ্যমকর্মী, সাংবাদিক।
তেইশ বছর আগে এই দিনটিতে, প্রথম যখন ওকে আমার বুকে দিলেন ওর দাদুমা মানে আমার মা, মামনি। কোথা থেকে যেনো হুহু কান্না ভর করেছিলো দুচোখে, সাথে আমার মামনিও কাঁদছিলেন। সেই কান্না ছিলো আনন্দের। প্রথম পিতা হবার। বুক ভরে যাবার। অথচ আজ প্রতিদিন কাঁদি, যে কান্নায় নিঃশব্দে বুকের ভেতরটা ভেঙে যায়। ওকে যখন প্রথম কোলে নিই তখন কি ভেবেছিলাম আমার এই ছেলেটা পৃথিবীতে বাইশটা ফাগুন পূর্ণ করতে পারবে না। একুশ ফাগুনেই চলে যেতে হবে আমার ফাগুনকে।
আমার পিতা মানে আব্বু। ফাগুন ডাকতো দাদুবাবা বলে। ওর জন্মের পর আব্বু, ফাগুনের দাদুবাবা এক মন মিষ্টি কিনতে পাঠালেন, বললেন আশেপাশের কেউ যেনো বাদ না যায়। তাতেও মন ভরছিলো না, আরও আধামন মিষ্টি এলো, মিলে দেড়মন মিষ্টি বিলানো হলো আশেপাশের মানুষদের। আহা, কি আনন্দই না ছিলো সেদিন। আমাদের পরিবারের সবচেয়ে আনন্দের দিন। প্রথম পিতা হবার আনন্দ। প্রথম দাদা-দাদি, নানা-নানি হবার আনন্দ। হায়, আনন্দ। যে আনন্দের গল্প আজ পরিণত হয়েছে শোকগাথায়।
অসম্ভব আদরে মানুষ হয়েছে ফাগুন। ওর দাদা-দাদি ফাগুনকে মাটিতে রাখতে দেয়নি পিঁপড়ার ভয়ে, মাথায় রাখেনি উকুনের ডরে, অবস্থা ছিলো এমনটিই। এত আদরে বিগড়ে যাবার কথা অনেক বাচ্চারই। কিন্তু ফাগুন বিগড়ায়নি। ছোট থেকেই সব জায়গাতেই নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছিল সে। যখন ক্লাশ এইটে, ওর পড়াশোনা নিয়ে শংকিত ওর মা। গেলাম ওর স্কুলের প্রিন্সিপালের কাছে। সজ্জন মানুষ এবং আমাদের আত্মীয়ও। সরাসরি বেডরুমে। রুমের কম্পিউটারটা খোলা, স্কুলের প্রশ্ন করছিলেন তিনি। সম্ভবত ইংরেজি প্রশ্ন এবং সেটা ফাগুনদের ক্লাশেরই। কম্পিউটারে চোখ পড়তেই ফাগুন টিচারকে বললো স্ক্রিনটা মিনিমাইজ করতে। যেনো ওর চোখে প্রশ্নটা আর না পড়ে। ওই বয়সেই কতটা সৎ, কতটা বিশুদ্ধ হলে একটা ছেলে প্রশ্ন দেখার সুযোগ পেয়েও ছেড়ে দেয়। ‘আই অ্যাম এ জিপিএ ফাইভ’ প্রজন্মকে জিজ্ঞেস করুন তো, কয়জনে এমন সুযোগ ছাড়বে। সেদিনই বুঝেছিলাম শিক্ষা বৃথা যায়নি। জুনিয়র স্কলারশিপটাও পেয়েছিলো ফাগুন।
ফাগুন যখন ক্লাশ টেনে তখনই বুঝতে পারছিলাম ইংরেজির প্রতি ওর আকর্ষণটা। তারপর তো ইংরেজি বিষয়ক প্রতিযোগিতার তিনটি বিভাগেরই প্রথম পুরস্কারই নিজ হাতে ওকে দিতে হয়েছে আমার। না, শুধু আমি নই, পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন উপসচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা। আমি ছিলাম বিশেষ অতিথি। ইংরেজি শেখানোর একটি প্রতিষ্ঠান সেই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলো। সেই প্রতিষ্ঠান প্রধান আমাকে জানতে দেননি ফাগুন পুরস্কার জিতেছে। কারণ তা হলে আমি যেতাম না, তা তিনি জানতেন।
যখন প্রতিযোগিতার তিনটি বিষয়েই প্রথম হিসাবে ফাগুনের নাম ঘোষিত হলো তখন রীতিমত বিব্রতকর অবস্থায় আমি। মাথা নিচু করে বসে আছি। বিজয়ী বাচ্চাদের নিজেদের অনুভূতি বর্ণনা করতে ডাকা হচ্ছে মঞ্চে এবং তা ইংরেজিতে। তৃতীয় হওয়া বাচ্চাটি এলো, বললো। ভালো ইংরেজি। কিন্তু বাচ্চাটির উচ্চারনে প্রবল দেশি টান। আমি তো লজ্জা পাচ্ছি, ফাগুন কী করে এই ভেবে। দ্বিতীয় হওয়া ছেলেটি এলো, বললো। প্রবল চেষ্টা স্বদেশিপনা কাটানোর। চেষ্টা সফল হলো না তার। আমার মাথা আরেকটু নুয়ে পড়লো। এবার ফাগুনের পালা কী জানি হয়। ফাগুন মঞ্চে উঠে এসেছে কখন দেখতে পাইনি। ও যখন বলা শুরু করলো তখন মাথাটা উঁচু হয়ে উঠলো, গর্বে নয় বিস্ময়ে। এত ভালো ইংরেজি, এত সুন্দর উচ্চারণ, এও কি সম্ভব! প্রধান অতিথি যখন পুরস্কার তুলে দিচ্ছিলেন তার সাথে আমিও হাত লাগিয়েছিলাম। পুরস্কার তুলে দেয়ার সময় সচিব সাহেবকে প্রতিষ্ঠানের প্রধান জানালেন ফাগুন আমার ছেলে। তিনিও বিস্মিত ছিলেন ফাগুনের ইংরেজি কথনে। ছেলের সাথে আমাকেও অভিনন্দন জানালেন তিনি। আহা, কী আনন্দ। যে আনন্দ আজ শুধু স্মৃতিগাথা।
আর ওর গণমাধ্যমের কাজের কথা তো অনেকেই জানেন। বিভিন্ন জন লিখেছেন ফাগুনকে নিয়ে। আমিতো লিখেছিই। তাই আজ আর ওদিকে যাই না। আজ ছোটবেলার কথাই থাক। আমার পিতা হয়ে উঠার স্বার্থকতার কথা বলি। একজন পিতা হিসাবে নিশ্চিত আমি স্বার্থক। এত অল্প বয়সেই একটা ছেলে একজন পিতার জন্য যতটুকু সম্মান বয়ে নিয়ে আসার তা নিয়ে এসেছে। অনেক পিতারই এক জনমেও এতটুকু সম্মান পাওয়া হয়ে উঠে না। কোথাও ওকে কেউ খারাপ বলেনি। ওর বিভাগীয় প্রধান বলছিলেন, ওতো ক্লাশই করে না। সাংবাদিতা নিয়েই মেতে থাকে। অথচ পরীক্ষায় এত ভালো লিখে কীভাবে। ওর কাজের জায়গাও একই কথা। এই ভালোর রহস্য ফাগুনেরই জানা ছিলো। ও নেই তাই সেই রহস্য জানারও উপায় নেই। ফাগুন রেজা নিজেই আজ এক রহস্য।
তেরো মাস হয়ে চললো গণমাধ্যমকর্মী, গণমাধ্যমের ইংরেজি বিভাগের একজন প্রতিশ্রুতিশীল উপসম্পাদক খুনের শিকার হলেন। তার আগে নিখোঁজ হলেন তথা গুম হলেন। তারপর তার মৃতদেহ পাওয়া গেলো রেললাইনের পার্শ্বে। হত্যা মামলা হলো। তার ফোন উদ্ধার হলো, সন্দেহভাজন গ্রেপ্তার হলো। মূল আসামীদের সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া গেলো, কিন্তু তাদের গ্রেপ্তার করা হলো না আজ অবধি। কেনো, এই প্রশ্নটা বড় হয়ে উঠছে ক্রমেই। করোনাকাল বলে হয়তো এই বড় হয়ে উঠার পরিমাপটা বোঝা যাচ্ছে না, তবে প্রশ্নটা এতটা বড় হয়েছে যে, সহজে মুছে যাবে না।
গত বছরে ২৯ জুন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সমুখে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে উপস্থিত থেকে এই হত্যাকান্ডের বিচার চেয়েছিলেন আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ফাগুন রেজা তার ভাইয়ের ছেলে বলে নয়, তিনি বলেছিলেন, ‘এ হত্যাকান্ডের বিচার না হলে বিচারহীনতার ভয়ে আক্রান্ত হবে তরুণেরা। মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে।’ মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে, ভালোমন্দ বিচারবোধ হারায়। আজ সেই প্রতিবাদেরও এক বছর পুরো হয়েছে। বিচার আমরা পাইনি। তবু আশা ছাড়িনি। এখনো হতাশ হয়ে পড়িনি। এখনো ভালোমন্দ বিচারবোধ রয়েছে। তাই যারা তদন্তের দায়িত্বে বিষয়টি ভেবে দেখবেন, আমাদের যেন হতাশ হয়ে পড়তে না হয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।