কাকন রেজা:
একে একে নিভেছে দেউটি। রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার উদাহরণ যে কয়জন মানুষকে নিয়ে দেয়া যেতো অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ তার অন্যতম। প্রবীণ সৌহার্দ্যতার নিদর্শন তার মাঝে ছিলো, যা আমাদের সুখ অতীতকে মনে করিয়ে দেয়। বিএনপির রাজনীতির ধারক ছিলেন তিনি। তার রাজনৈতিক চিন্তা ছিলো বিএনপির জাতীয়তাবাদী দর্শনে। অথচ অন্য রাজনীতি ও দর্শনের প্রতি তার ‘বিরাগ’ ছিলো না। ‘বিরাগ’ শব্দটি যে অর্থে ব্যবহৃত হয়, সেই ঔদাসীন্য থাকাটাও দোষের কিছু নয়। তবু অন্য রাজনীতির প্রতি তার ঔদাসীন্য ছিলো না বরং অনুরাগ ছিলো। অন্য রাজনীতিকে আত্মস্থ করে তিনি নিজের রাজনীতির বিকাশ করতে চাইতেন। কিন্তু বর্তমানের রাজনীতিতে ‘বিরাগ’ প্রতিস্থাপন হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিহিংসায়, প্রতিহিংসার রাজনীতিতে।
অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের বয়স হয়েছিলো। তিনি তার জীবনের মূল অংশটাকে কাজে লাগাতে পেরেছিলেন। তাই তার এই প্রস্থান বয়সজনিত কারণে খুব একটা হতাশার কথা বলে না। তবে তার থাকাটা কিছুদিন হলেও জরুরি ছিলো। তিনি ছিলেন আমাদের সমুখে দৃশ্যমান রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার উদাহরণ। রাজনীতিতে বুদ্ধিবৃত্তির জায়গা এবং তার প্রয়োজনীয়তা দেখাতে আমাদের এমন উদাহরণ বড় দরকার। বিশেষ করে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের এই যুগে।
এমাজউদ্দীন আহমদ তার রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ এমন কোনো নীতি অবলম্বন করেননি। তিনি বিএনপির রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন এবং অকপটে সেই রাজনৈতিক চিন্তার কথা বলেছেন। সেই রাজনৈতিক দর্শনের চর্চা করেছেন। অন্তত তিনি ‘ছুপা রুস্তম’ ছিলেন না। এখন যেমন দেখি, নিজেকে নিরপেক্ষ ঘোষণা করে পক্ষপাতিত্বের চুড়ান্ত করেও নির্লজ্জ থাকেন। সব রকম রাজনৈতিক নষ্টামি করেও নিজেকে ‘তুলশী পাতা’ হিসাবে প্রতীয়মানের অপচেষ্টা করেন। এমাজউদ্দীন আহমদ অন্তত এই কাজটি করেননি। পঁচে যাওয়া বুদ্ধিজীবীদের সারিতে উনি দাঁড়াননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন ছাত্র-শিক্ষকের রসায়নের কোনো ব্যত্যয় তিনি ঘটাতে দেননি। বিএনপি সরকারের সময়েও সর্বপন্থীদের জন্য তার দরোজা খোলা ছিলো। রাজনৈতিক বিভাজন তাকে তাড়িত করেনি ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কে। এমনকি প্রশাসনেও নির্লজ্জ রাজনৈতিক প্রদর্শনবাদীতা তার ছিলো না। বিপরীত রাজনীতির চিন্তার অনেক শিক্ষকই তার সময়ে নিয়োগ পাওয়া। চিন্তার ক্ষেত্র ছাড়া কাজের ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা রাজনৈতিক স্বার্থ তাকে খুব গ্রাস করতে পারেনি। তার সেই চিন্তার ক্ষেত্রটিও ছিলো শুদ্ধ দর্শন চর্চার।
এমন একজন মানুষের মৃত্যুতে শোক প্রকাশে কোন দ্বিধা থাকার কথা নয়। সে যদি বিপরীত চিন্তারও হয়। অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের মৃত্যুতে সেই দ্বিধাহীন শোক।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।