ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার ঢাকা সফর নিয়ে নানা হিসাব নিকাশ চলছে। উত্তাপও ছড়িয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশে দেশে পরখ করে দেখা হচ্ছে ঢাকার সঙ্গে দিল্লীর সম্পর্ক কোনদিকে মোড় নেয়। হঠাৎ করেই কেন হাই প্রোফাইল সফরটি একদম লো প্রোফাইলে চলে গেল। কী এমন ঘটলো যে কারণে বিমানবন্দরে কেউ গেল না অভ্যর্থনা জানাতে! প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠকের সময় কেন বারবার বদল হলো। হোটেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পালা যখন শেষ হলো তখনও হর্ষ বর্ধন ভাবেননি সামনে কী অপেক্ষা করছে।
বৈঠক যখন হলো তখন একদম শুনশান নীরবতা। কোন ঘোষণাও এলো না প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে। বৈঠকের কোন ছবিও রিলিজ হলো না। আগেই টেলিভিশন রিপোর্টারদের বলা হয়েছিল, কোন খবর নয়।
সরকারি সূত্রের বরাতে কোন মিডিয়াতেই খবর গেল না। অথচ মার্চ মাসে যখন শ্রিংলা ঢাকা সফরে আসেন তখন ছিল অন্যরকম উচ্ছ্বাস, আবেগ। রাজকীয় সব আয়োজন। এবার যেন সব পাল্টে গেল। হর্ষ বর্ধন অবাক হলেন, কিন্তু প্রকাশ করলেন না। এটাই কূটনীতির বিউটি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন কেন তিনদিনের সফরে সিলেট চলে গেলেন তা নিয়েও বিস্তর আলোচনা চলছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, তার সঙ্গে যেহেতু কোন পূর্ব নির্ধারিত বৈঠকের সূচি নেই সে কারণেই তিনি সিলেট চলে যান।
গণভবনে কী আলোচনা হয়েছে তা জানা সম্ভব হয়নি। নানা সূত্রে যেসব খবরাখবর বের হয়েছে তাতে মনে হয় বরফ গলেনি। বাংলাদেশ একটি পাল্টা বার্তা দিয়েছে। কূটনীতির পরিভাষায় বলা হয় ‘সম্পূর্ণ একমত হওয়া গেল না’। ওয়াকিবহাল কূটনীতিকরা বলছেন, এই বৈঠক থেকে সন্দেহ আর সংশয় আরও জমাট বেঁধেছে। এসবই চীনকে নিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের উপস্থিতি মানতে পারছে না দিল্লী। বিশেষ করে বাংলাদেশে চীন যেভাবে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে তাতে ভারত বিচলিত, কোণঠাসা। শুধু অর্থনীতির ক্ষেত্রে নয়। রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়েছে চীন।
বাংলাদেশের গত সাধারণ নির্বাচনে চীনের ভূমিকা দেখে ভারত হতবাক হয়েছিল। তারা যা চেয়েছিল তার উল্টোটা ঘটেছিল। একতরফা নির্বাচনে চীন তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। এতে করে দিল্লী আরও সন্দিহান হয়ে পড়ে। মনে রাখা ভাল, চীন তার আঞ্চলিক নীতিতে আগেই পরিবর্তন এনেছে। এখন সে আর অর্থনৈতিক কূটনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ব্যবসার সঙ্গে রাজনীতিকেও যুক্ত করেছে। এ কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশে দেশে অনেক হিসাবই পাল্টে গেছে এবং যাচ্ছে। একদা এই অঞ্চলে ভারতের একচেটিয়া প্রভাব ছিল। দাবার গুটি ছিল তাদের হাতে। তারা যেভাবে চেয়েছে সেভাবেই চাল দিয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক সহযোগিতার সুযোগে দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চলে চীন তার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। নেপাল হাতছাড়া হয়েছে। শ্রীলঙ্কায়ও ভারতের পছন্দের সরকার নেই। ভুটানের সঙ্গে নানা বিষয়ে টানাপোড়েন চলছে। মালদ্বীপ এখনও আছে। তবে চীন বসে নেই। খেলছে নানাভাবে। পাকিস্তানতো চিরশত্রুর কাতারেই। তিনটি যুদ্ধের অভিজ্ঞতা রয়েছে দেশ দু’টোর। বাকি ছিল বাংলাদেশ। ঐতিহাসিক সম্পর্ক দুই দেশের। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা বরাবরই স্মরণ করা হয় কৃতজ্ঞতার সঙ্গে। খুব কম বাংলাদেশিই আছেন সে সময়কার ভারতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। যদিও স্বাধীনতার পরপরই একধরনের অবিশ্বাস দানা বেধেছিল। যে কারণে আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল জাসদ। যদিও ভুল চালে নিজেরাই অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে।
যাইহোক, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিকও। এখানে অবশ্য সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কেরও বদল ঘটে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কের তেমন হেরফের হয়নি। বরং বিগত ১২ বছরে সম্পর্ক শিকড়ে পৌঁছেছে। এটা একতরফা নয়। বাংলাদেশ সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। দিল্লীও এগিয়ে এসেছে। বিএনপির জমানায় এ সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। আবেগ আর উচ্ছ্বাসে ভরপুর হয়ে ওঠে কংগ্রেস জমানায়। বিজেপি আসার পরও এর কোন ব্যত্যয় দেখা যায়নি। তাহলে কী এমন ঘটলো যে কারণে এই সম্পর্ক হিমশীতল হয়ে গেল! ভর করলো অবিশ্বাস!
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চীনের ভূমিকায় দিল্লী বিচলিত হয়ে পড়েছে। তারা মনে করছে, চীন যদি বাংলাদেশে পরিপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে ফেলে তখন সে চারদিক থেকে একঘরে হয়ে যাবে। কিন্তু দিল্লী কি একবারও ভেবে দেখেছে সে তো বরাবরই একঝুড়িতে সব আম রেখেছে! এখন যখন পরীক্ষিত বন্ধুর সঙ্গে ফারাক তৈরি হয়েছে তখন গোটা বাংলাদেশই তার হাতছাড়া হতে চলেছে। জনগণ নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে।
শেখ হাসিনা বোধকরি এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইবেন না। একদিকে উন্নয়ন, অন্যদিকে রাজনীতি। তিনি বেছে নিয়েছেন উন্নয়ন। উন্নয়ন মানেই চীনের সহযোগিতা। এই সুযোগটা অবশ্য একদিনে তৈরি হয়নি। বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পগুলো চীনের অর্থায়নেই হচ্ছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর ঢাকা সফর এক ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল। ভারত তখন থেকেই সন্দিহান। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। সেও যে চীনের সহযোগিতা প্রত্যাশী। বাংলাদেশ যখন চীনের কাছ থেকে দুটো সাবমেরিন কিনে তখন ভারতীয় মিডিয়া নানা প্রশ্ন তুলেছিল। অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন, বাংলাদেশের সাবমেরিন কেনার প্রয়োজন কী? বাংলাদেশ কার সঙ্গে যুদ্ধ করবে? নানা অপপ্রচারের মধ্যেও হাসিনা দমেননি। পর্দার আড়ালেও নানা খেলা চলছিল তখন। চীন তখন থেকেই গুটি সাজাতে শুরু করে। বাংলাদেশের কাছাকাছি চলে আসে। একজন অভিজ্ঞ চীনা কূটনীতিক ছায়ার মত লেগে আছেন। বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ হিসেবেই তিনি সমধিক পরিচিত।
চীনে বাংলাদেশি পণ্যর শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়ার খবর যখন চাউর হয় তখন ভারতীয় মিডিয়া অসম্মানজনক মন্তব্যও করে। যার কারণে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয় বাংলাদেশে। লাদাখ সীমান্তে যখন ভারত-চীন গুলির লড়াই হয় তখন এই অঞ্চলের রাজনীতি অনেকটা পাল্টে যায়। ভারত আশা করেছিল, আর কেউ না থাকলেও বাংলাদেশ তার পাশে থাকবে। চীনা আগ্রাসনের নিন্দা জানাবে। কিন্তু বাংলাদেশ সবাইকে হতবাক করে জাতিসংঘের মত শান্তির পক্ষে আওয়াজ তোলে। দিল্লী হতাশ হয়। কিন্তু প্রকাশ করে না। যদিও এর আগে নাগরিকত্ব আইন নিয়ে দু’দেশের সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়। পরিণতিতে অনেকগুলো নির্ধারিত সফর বাতিল হয়ে যায়। করোনা মহামারীকালে চীন নতুন কৌশল নেয়।