কাকন রেজা :
আমার ছোট ছেলেটার রেজাল্ট হলো আজ। হ্যাঁ, এসএসসি দিয়েছিলো এবার। এ প্লাস পেয়েছে। মাইনাস পেলেও সমস্যা ছিলো না। যে দেশে রেজাল্টের গ্রাফ উল্টো চলে সেখানে প্লাস মাইনাসের পার্থক্য করা বোকামি। যে দেশে একজন আমলাকে গবেষকের স্যার ডাকতে হয় সে দেশে প্লাস মাইনাসের হিসেবে না যাওয়াটাই ভালো। ‘স্যার সিনড্রমে’ আক্রান্ত দক্ষিণ এশিয়ায় ‘স্যার’ ডাক শোনাটাই প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেধার ব্যাপারটি এখন কথার কথা মাত্র।
কেন মেধার ব্যাপার কথার কথা, বলি। ধরুন আপনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছেন কলা বিভাগে। আপনার চান্স হলো। ভালো কথা গিয়ে দেখলেন, আপনি সাবজেক্ট পেয়েছেন ফিলোসফি। এতে আপনার কোনই আগ্রহ নেই বরং নিজেও সিক্সটিনাইন সাবজেক্ট বলে অন্যদের খেপিয়েছেন। আপনার উপায় নেই, পেয়েছেন যখন সেই সাবজেক্টেই আপনাকে পড়তে হবে। অথচ আপনি মনেপ্রাণে চান সাহিত্য নিয়ে পড়তে। সাহিত্যের সাথে ফিলোসফির বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই বরং উল্টো। সুতরাং আপনাকে পড়তে হচ্ছে অনাগ্রহেই। অনাগ্রহের বিদ্যা কি সম্পূর্ণ হয়? হয় না। আপনার স্বজনরা হয়তো খুশি হলেন, আপনি অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছেন, পড়ছেন। তবে আখেরে কী হলো, আপনি একটা শিক্ষিত ‘ইয়ে’ হলেন।
আর আপনার মতন ‘ইয়ে’রাই জাকিয়ে বসে গেলেন দেশের বিভিন্ন জায়গায়। অথচ আপনার গবেষণা করার কথা ছিলো সাহিত্যের উপর। আপনার ইচ্ছা-আকর্ষণ পুরোটাই ছিলো সাহিত্যের প্রতি। আপনি একটা কিছু হতে পারতেন সাহিত্যের জায়গায়। বিপরীতে আপনি হয়ে গেলেন অনিচ্ছার কর্মচারি। আর তা সিস্টেমের গলদে। বলিহারি সিস্টেমের।
তারপরও কথা রয়েছে। আপনি পাশ করেছেন ফিলোসফি থেকে বিসিএস দিয়ে হয়ে গেলেন পুলিশ কর্মকর্তা। দেখুন চেঞ্জওভারগুলো। আপনি সাহিত্যের মানুষ, পড়লেন ফিলোসফি। না হতে পারলেন সাহিত্যিক না ফিলোসফার। হতে হলো পুলিশ কর্মকর্তা। আপনার ইচ্ছা পূরণ হলো না। অনিচ্ছার পড়াশোনায় যা শিখেছিলেন তাও খাটানো গেলো না। হতে হলো পুলিশ। তো আপনি কিভাবে শতভাগ দায়িত্ব পরায়ন একজন পুলিশ কর্মকর্তা হবেন? অনেকে বলবেন আমিতো হয়েছি। মিথ্যা কথা। বুকে হাত দিয়ে বলুনতো হয়েছেন কিনা?
এমন অনেক কর্মকর্তাকে দেখেছি তারা দায়িত্বের মূল কাজ ফেলে পড়ে থাকেন নিজ ইচ্ছা পূরণের গোপন বাসনা নিয়ে। কেউ সাহিত্য করেন, কেউ বাগান পরিচর্যা। কেউ কাজের চেয়ে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের রাস্তায় হাঁটেন। অর্থাৎ কাজের চেয়ে রাজনীতি করতে লেগে যান। ফলে কোনো কাজটাই ঠিকমতো হয়ে উঠে না। তালগোল পাকিয়ে যায় সবখানে।
আমি যা পড়তে চাই তা পড়তে পারবো না কেন? এটা আমার অধিকার। উন্নত বিশ্বে দেখান তো ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন শিক্ষার্থীকে আপনি পড়াতে পারেন কিনা। তারা তাদের পছন্দ অনুযায়ীই পড়বে। সঙ্গতই তারা যে যার জায়গা থেকে ক্লিক করবে এবং করা উচিত।
দুটো উদাহরণ দিই। প্রথমত আমার এক ভাইয়ের। তিনি জিওগ্রাফিতে অনার্স মাস্টার্স। তার বিষয়ে নয় উল্টো তিনি খ্যাত বাংলাদেশের কম্পিউটার জগতে। নেটওয়ার্কিং, প্রোগ্রামিং এর ওস্তাদ তিনি। বাংলাদেশে হাতেগোনা যে কয়জন ওস্তাদ মানুষ রয়েছেন তার নাম প্রথম সারির দু’একের মধ্যেই। অথচ তার পড়াশোনাটা যদি তার পছন্দের ক্ষেত্র অনুযাযী হতো, তাহলে হয়তো তিনি আরো অনেক দূর যেতে পারতেন, অনেক কিছুই করতে পারতেন।
আমার এক প্রিয় অনুজের কথা বলি। খুব ভালো কবিতা লিখতো কলেজে থাকাকালীন। মেধাবী ছেলে এবং সামাজিক ইচ্ছা অনুয়ায়ী বিজ্ঞানের ছাত্র। স্বজনদের ইচ্ছা সে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হোক। টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত চিন্তা আর কী। ওর ইচ্ছা ছিলো সাহিত্য পড়ার। পরিবারে চাপে বিজ্ঞান পড়েছে। এইচএসসি পাশ করার পর পরিবারকে না জানিয়েই পরীক্ষা দিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগে। মেধা ও ভাগ্য দুটোই কাজ করলো। বাংলায় চান্স হয়ে গেলো তার। আজ সে নামী অধ্যাপক, গবেষক। অনেকগুলো বই রয়েছে তার। সাহিত্যে তাকে সবাই চিনে। শিক্ষক হিসাবেও অসম্ভব ভালো। ছাত্রদের খুবই পছন্দের একজন মানুষ। সে তার পছন্দের প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছিলো বলেই তার এমন অবস্থান।
সুতরাং আগ্রহ অনুযায়ী বিষয় পছন্দের সুযোগ দেয়া গেলে আমাদের মেধাবীরাও ভালো করতো। মেধার সে অনুযায়ী বিকাশ না হওয়াতেই আজ পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় ‘স্যার সিনড্রম’ জাকিয়ে বসেছে। এখনের শিক্ষার্থীরা তাই মেধা বিকাশের চিন্তা করেন না, গবেষণার চিন্তা করেন না। তাদের লক্ষ্য থাকে একটাই, পাশটা করেই বিসিএসে বসে যাওয়া। সরকারি একটা চাকরি বাগানো। পুলিশ হলে খুব ভালো, মূল প্রশাসনে গেলে বেশ ভালো। আর তা না হলে কোন একটা দপ্তর হলেও চলবে। লক্ষ্য একটাই সরকারি চাকরি, অর্থাৎ জীবন ধারণের নিশ্চয়তা। মন খারাপ করার কিছু নেই, এটাই বাস্তবতা।
দু’একজন অবশ্য এরমধ্যেই ঝিলিক দিয়ে উঠেন। যেমন হুমায়ূন আহমেদ। কোয়ান্টাম কেমেস্রিছুর খটমট বিষয় পড়েও সাহিত্যের বরপুত্র হয়ে উঠেছেন। এখন পর্যন্ত তাকে ডিঙিয়ে যাবার মতন সমসাময়িক লেখক আর নেই। এমন উদাহরণ হাতেগোনাই।এছাড়াও অনেক মেধাবী রয়েছেন আমাদের, যারা তাদের জায়গা পেলে অনেক কিছুই করে দেখাতে পারতেন। সিস্টেমের কারণে তারা পারছেন না, পেরে উঠছেন না।
গুপ্ত হত্যার শিকার আমার বড় ছেলেটার কথা বলি। ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন, ফাগুন রেজা। ইংরেজি গণমাধ্যমে কাজ করতো যে। অথচ ইংরেজি তার বিষয় ছিলো না। সে ইংরেজিতে ভর্তি হতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়ে। যার ফলেই বাধ্য হয়ে অন্য একটা বিষয় পড়তে হয়েছে তাকে। অথচ সে কাজ করেছে গণমাধ্যমের ইংরেজি বিভাগের সাব-এডিটর হিসেবে। তার সহকর্মীসহ গণমাধ্যমের অনেক বড় মানুষই তার ইংরেজির সাবলীলতা ও দক্ষতা দেখে আশ্চর্য হয়েছেন। অথচ সে তার পছন্দের বিষয় পড়তে পারেনি সিস্টেমের গলদে।
আরো উদাহরণ রয়েছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে জানি। নামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মাসিতে পাশ করেছেন। তার গবেষক হওয়ার কথা ছিলো। হয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা। তার পড়াশোনাটা কাজে লাগলো কি? না, লাগেনি। দেশে হয়তো পুলিশ কর্মকর্তা আরো পাওয়া যেতো, একজন গবেষককে পাওয়া যেতো না। এই মহামারির কালে আমরা দেখছি, একজন গবেষকের প্রয়োজনীয়তা। হাতেগোনা যে কয়জন মেধাবী গবেষক দেশে রয়েছেন, তাদেরও দেখা যাচ্ছে এলেবেলে ধরণের কোন আমলাকে ‘স্যার’ ডাকতে হচ্ছে। লালফিতার দৌরাত্মে তাদের গবেষণা বিষয়ক ফাইল আটকে আছে। যে আমলার হয়তো সেই ফাইলের মাহাত্ম্য বোঝারই ক্ষমতা নেই।
তাই বলি, রেজাল্ট নিয়ে এত মাথাব্যথার কিছু নেই। আমাদের দেশের মূল টার্গেট হলো বিসিএস। কোন রকমে পেরোতে পারলেই কেল্লাফতে। নিশ্চিত জীবনযাপন। হাতকচলে টিকে থাকতে পারলেই হলো।
সামাজিকমাধ্যমে একজন কবির মন্তব্য ছিলো এরকম, ‘যারা এ প্লাস পাইছ তারা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হবা। যারা এ পাইছ তারা সচিব হবা। আর যারা কিছুই পাও নাই তারা মন্ত্রী হবা। ফলে যারা কিছুই পাও নাই তারা কান্দাকাটি বাদ দেও…’
এই মন্তব্যটি কারো ব্যঙ্গ করার জন্য নয়। এটি হলো বিক্ষুব্ধ কথকতা। গলদ সিস্টেমের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বিচ্ছুরণ। এই ক্ষোভ স্বাভাবিক, এই ক্ষোভ সঙ্গত।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।