শত শত অভিযোগ, জলাবদ্ধতা, অব্যস্থাপনা- তবু তিনি এগারো বছর ধরে ওয়াসার এমডি! নিজেই আরও তিন বছর চেয়ারটা ধরে রাখতে চাইছেন, সেই মোতাবেক ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে! ঢাকা ওয়াসাকে তার পারিবারিক সম্পত্তি বললে কি খুব বেশি ভুল হবে?
ওয়াসার এমডি হিসেবে তাকসিম এ খানকে আবারও নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। ছুটির দিনে বৈঠক করে গতকাল ওয়াসার বোর্ড সভায় এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, শিগগিরই তাঁকে আবার তিন বছরের জন্য নিয়োগ দিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হবে। সেখান থেকে প্রস্তাবের সারাংশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলে নিয়োগ চূড়ান্ত হবে।
প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলেই টানা ষষ্ঠবারের মতো ওয়াসার এমডি নিয়োগ পেয়ে যাবেন তাকসিম এ খান। ২০০৯ সাল থেকেই তিনি সংস্থাটির এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, এগারো বছর হয়ে গেছে, আরও তিন বছর, অর্থাৎ টানা ১৪ বছর একই সংস্থা চালানোর রেকর্ড গড়ে ফেলবেন তিনি। গিনেজ বুকে খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে এটাও একটা রেকর্ড, সরকারী কোন দপ্তরের প্রধান হিসেবে একই ব্যক্তি এত বছর ধরে দায়িত্ব পালন করার ইতিহাস এর আগে আছে কিনা, সেটাই বা কে জানে!
২০০৯ সালে যখন তাকসিম এ খান ঢাকা ওয়াসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন , তখনও ভারী বৃষ্টিতে ডুবে যেত রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকা, এখনও একই অবস্থা বদলায়নি তেমন কিছু। ওয়াসার সরবরাহ করা পানি খাওয়ার তো বটেই, রান্না করারও অযোগ্য। পানিতে ময়লা, দুর্গন্ধ থাকার অভিযোগ তখনও ছিল, এখনও আছে। রাজধানীর প্রায় ৮০ ভাগ এলাকায় পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। ১১ বছর আগেও একই অবস্থা ছিল। এত সব ব্যর্থতার পরেও, বারবার নানা সমালোচনায় জেরবার হয়েও তাকসিম এ খান নিজেই বলেন, তিনি আরও তিন বছর ওয়াসার এমডি পদে থাকতে চান! এবং তার চাহিদা অনুযায়ী একদিনের নোটিশে বিশেষ বোর্ড আয়োজন করে মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশও করা হয়েছে!
ওয়াসার এমডি হিসেবে তাকসিম এ খানের মেয়াদ শেষ হবার কথা অক্টোবরের ১৪ তারিখে। ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিতর্কিত নিয়োগের পর তিনি প্রশ্নবিদ্ধ প্রক্রিয়ায় টানা পাঁচ মেয়াদে ১১ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। অভিযোগ আছে, প্রতিবারই তার নিয়োগ নবায়নের ক্ষেত্রে কোনো না কোনোভাবে আইন ও নিয়ম ভাঙা হয়েছে। এমনকি প্রথমবার নিয়োগের সময়ই অনিয়মের অভিযোগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে পরবর্তী নিয়োগে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য দালিলিক নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
তারপরও কখনো বয়সসীমা বাড়িয়ে, আবার কখনো বোর্ডের সাম্প্রতিক সভার সুপারিশ পাশ কাটিয়ে পুরনো সভার তামাদি সুপারিশ ব্যবহার করে, এমনকি বোর্ডের মতামত গ্রহণেরই তোয়াক্কা না করে প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশে তার পুনঃনিয়োগ নিশ্চিত করা হয়। এমনকি একটি ক্ষেত্রে একজন বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকা মন্ত্রীর লিখিত নির্দেশও অমান্য করা হয়েছিল। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, এগারো বছর ধরে এতসব বিরোধিতা সামলে কীভাবে পদ আঁকড়ে ধরে আছেন তাকসিম এ খান? সেটাকে চৌদ্দ বছরে বাড়িয়েই বা নিচ্ছেন কিভাবে? এভাবে বারবার মেয়াদ না বাড়িয়ে তাকে ওয়াসার আজীবন এমডি হিসেবে ঘোষণা করে দেয়াই কি বরং ভালো না?
তাকসিম এ খানের আমলেই আমরা পানি নিয়ে আন্দোলন হতে দেখেছি। মন্ত্রীরা পর্যন্ত তাদের বাসার পানি ফুটিয়ে পান করেন, অথচ ওয়াসার এমডি তোতাপাখির মতো মুখস্ত বুল আউড়ে যান- ওয়াসার পানি শতভাগ বিশুদ্ধ! ওয়াসার পানি শতভাগ বিশুদ্ধ! খিলগাঁও থেকে এক অ্যাক্টিভিস্ট যখন ওয়াসার লাইনের পানি জগে করে এমডি সাহেবকে খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন, তখন কিন্ত তিনি অফিস ছেড়ে নেমে আসার সাহস করেননি, নিজে সেই পানি পান করে ওয়াসার বিশুদ্ধতার প্রমাণ দিতে দেখা যায়নি তাকসিম এ খানকে। বরং সেই অ্যাক্টিভিস্টই দফায় দফায় হেনস্থার শিকার হয়েছেন, তিনি অভিযোগ করেছিলেন, ওয়াসার কর্তাব্যক্তিদের ইশারাতেই তাকে হেনস্থা করা হচ্ছে।

মাথার ওপরে হাজার হাজার অভিযোগ নিয়েও একজন সরকারী কর্মকর্তা একটা দপ্তরের পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন একযুগ ধরে, নিজের ইচ্ছেতেই মেয়াদ বাড়াচ্ছেন- এমন বিরল দৃশ্যের দেখা বাংলাদেশেই পাওয়া সম্ভব। খাল খননের কাজে অগ্রগতি নেই, শহরের ড্রেনেজ সিস্টেম বা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও এখনও মান্ধারার আমলে পড়ে আছে, আধঘন্টার বৃষ্টিতেই ঢাকার আশিভাগ এলাকা ডুবে যায়। আর আমরা দোষ দিই জনগনের, পলিথিন আর চিপসের প্যাকেটের। আসল দোষটা যে ওয়াসার, সেটা এড়ানোই হয়তো এই ব্লেম গেমের মূল উদ্দেশ্য।
শীতকালে ওয়াসার নামে যত খোঁড়াখুঁড়ি হয় রাস্তাজুড়ে, সেসবের কোন ফল পাওয়া যায় না বর্ষায়। সেসব খোঁড়াখুঁড়ি যে নিজেদের পকেট ভারীর জন্য করা, এটা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না। গরমের সময় পানির জন্য হাহাকার চলে অনেক এলাকায়, মানুষকে রাস্তায় নেমে মানববন্ধন করতে হয় পানির জন্য। খাওয়ার পানির জন্য ধর্ণা দেয়া লাগে বারবার, বাড়তি দামে গাড়ি থেকে পানি কিনতে হয় অনেক এলাকাতেই। দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় ঢেকে থাকা একটা সংস্থায় পরিণত হয়েছে ওয়াসা গত কয়েক বছর ধরেই, নাগরিক সেবার ন্যুন্যতম মানটাও তারা ধরে রাখতে পারছে না, সেই চেষ্টাও নেই। তবু তাকসিম এ আহমেদ সংস্থাটির এমডির পদ ছাড়তে চান না, তিনি না থাকলে যে ওয়াসার ঐতিহ্যই বিলুপ্তির পথে পড়বে!
এদেশে অনেকেই একবার একটা পদ বাগিয়ে নিলে সেটাকে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সম্পত্তি ভেবে ফেলেন, সেই পদ ছাড়ার কোন আগ্রহ তাদের মধ্যে দেখা যায় না। সেটা ফুটবল ফেডারেশনের সালাউদ্দীন সাহেবই হোক, কিংবা ওয়াসার তাকসিম সাহেব- সবাই একই ঘরানার লোক। এখন বরাবরের মতো প্রধানমন্ত্রীই শেষ ভরসা দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করার কথা বলেন সবসময়। ওয়াসার দুর্নীতি আর অচলাবস্থাটা তার চোখে পড়লেই হয়। এগারো বছরে যে লোক ওয়াসায় কোন পরিবর্তন আনতে পারেননি, তিনি আগামী ত্রিশ বছরেও পারবেন না। কাজেই আরও তিনটা বছর তাকে ওয়াসার এমডি পদে রাখাটা ওয়াসা এবং ধাকার জনগন- দুই পক্ষের জন্যেই ভোগান্তির। আশা করি প্রধানমন্ত্রী সেটা ভেবেই সিদ্ধান্ত নেবেন…