আতিফ অনিক :
করোনার সময়ে সারাবিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের স্বাস্থ্যখাতেরও বেহাল দশা ফুটে উঠেছে।সারাদেশের বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক সবাই আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে লেখালেখি থেকে শুরু করে নানান ধরনের মন্তব্য গত তিন মাসে করেছি। পত্র-পত্রিকা, টিভি-মিডিয়া সব খানেই স্বাস্থ্যখাতকে জনমুখী করার দাবি উঠেছে।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার ব্যাপারে প্রচুর আলোচনা এই তিন মাসে হয়েছে। সরকারী বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা-ডাক্তার সকলেই এবিষয়ে উন্নয়নের দাবি তুলেছেন। স্বাস্থ্যখাতকে মৌলিকভাবে ঢেলে সাজানোর দাবিও উঠেছে।
সেই প্রেক্ষিতেই আগামী বাজেটে করোনার প্রভাব বিবেচনা করে স্বাস্থ্য বাজেট সাজানোর গুরুত্ব আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে চলমান অর্থবছরের মতোই গতানুগতিক একটি স্বাস্থ্য বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। সেখানে বরাদ্দ কিছুটা বাড়লেও তা বাস্তবে করোনা মোকাবেলাকে প্রতিফলিত করছে না।
কেমন বাজেট হতে যাচ্ছে
প্রস্তাবিত স্বাস্থ্য বাজেটে ২০১৯-২০২০ স্বাস্থ্য বাজেটের চেয়ে, স্বাস্থ্যখাতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এডিপির বরাদ্দ কম রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে করোনা মোকাবিলার বিষয়টি যে বাজেটে সেভাবে গুরুত্ব পায়নি সেটি বলা বাহুল্য। চলতি অর্থ বছরে এক্ষেত্রে বরাদ্দ ছিলো ১৩ হাজার ৫৫ কোটি টাকা এবং আগামী বাজেটে এর পরিমান ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ৩৩ কোটি টাকা। যা আক্ষরিকভাবেই বাজেটকে কমিয়ে দিচ্ছে।
অন্যদিকে আগামী স্বাস্থ্য বাজেটে অবকাঠামোগত দিকেই বেশি মনোযোগ দেয়া হয়েছে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা বলছে স্বাস্থ্যখাতে অবকাঠামোগত দিকে নজর দেয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি একটা বড় কারণ। বিশেষত অবকাঠামো খাতে মেগা প্রকল্প করা হলে সেখানে দুর্নীতির সুযোগ বেশি থাকে। এজন্য স্বাস্থ্য বাজেট পরিকল্পনা এবং স্বাস্থ্যখাতে কর্মরত কর্তাব্যক্তিদের অবকাঠামো নির্মানে যতটা আগ্রহ ততটা আগ্রহ নেই সেবার মানোন্নয়নে।গ্রাম বা প্রান্তিক পর্যায়ে কিভাবে স্বাস্থ্য সেবাকে পৌঁছে দেয়া যায়, সেভাবে কোন বাস্তব পরিকল্পনা দৃশ্যমান হয় না প্রতিটি বাজেটেই। এবারের বাজেটেও তার হের ফের হচ্ছে না শুধুমাত্র অর্থ বৃদ্ধি করা ছাড়া।
নতুন করে করোনাকে কেন্দ্র করে ঢেলে সাজানোর মতো কোন পরিকল্পনা বাজেটের মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে না। বরং অবকাঠামো গত খাতে কিছুটা বৃদ্ধি ঘটিয়ে বাজেটের আয়তন বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিছু কিছু প্রকল্প প্রয়োজনীয় হলেও স্বল্প মেয়াদে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জনসংখ্যা ও পরিবার কল্যাণ খাতে মোট ৬৭টি বিনিয়োগ প্রকল্পের মধ্যে ৩১টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই হাসপাতাল নির্মাণ এবং মেডিকেল কলেজ নির্মাণসহ অন্যান্য কিছু অবকাঠামো গড়ার জন্য। যা দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। অথচ এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি ছিলো স্বল্পমেয়াদী করোনাকে কেন্দ্র করে অবকাঠামোকে গুরুত্ব দেয়ার। সেদিকটা অবহেলিতই থেকে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে করোনার সময়ে আমরা আরো বেশি বিপদে পড়ার সম্ভাবনা তৈরী হতে যাচ্ছে।
আগামী বাজেটকে হতে হবে মূলত দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পকে সামনে রেখে স্বল্পমেয়াদী প্রকল্প যেটা দ্রুত করোনা মোকাবিলায় সক্ষম করে তুলবে সেরকম প্রকল্প। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা এমনটাই দাবি করছেন। নতুবা আমাদের বৃহৎ বৃহৎ অবকাঠামো কোন কাজেই আসবে না। মানুষ মরার পরে ডাক্তার আসার মতোই অবস্থা হবে আমাদের।
এছাড়াও আমাদের দেশের অতীত বাজেট পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, স্বাস্থ্যখাতে কর্মরতদের বেতন-ভাতা ঔষধ,চিকিৎসা নির্মাণ সামগ্রীতে ব্যয় অনেক বেশি ধরা হয়। অর্থাৎ পরিচালন ব্যয় থাকে অত্যধিক মাত্রায়।এক্ষেত্রেও স্বাস্থ্য বাজেটকে ঢেলে সাজাতে হবে। কোথায় কোথায় অতিরিক্ত ব্যয় সংকোচন করা যায় তা খুঁজে বের করতে হবে। নতুবা গতানুগতিক পরিকল্পনা দিয়ে করোনা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।
বাজেটে গত দশ বছরে অর্থ বরাদ্দের পরিমান বাড়েনি বরং কমে গেছে। কিন্তু বর্তমান করোনা পরিস্থিতি আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে যে, স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক পরিবর্তন ছাড়া সামনে এগোনোর কোন পথ নেই। স্বাস্থ্য কাঠামো ঠিক না হলে বিনিয়োগ এবং ব্যবসায়িক খাতেও তার প্রভাব পড়বে। কোভিড-১৯ থেকে এখনো মুক্তি পাওয়া যায়নি। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন করোনার মত ভাইরাস পুনরায় আক্রমণ করতে পারে। করোনা থেকে যদি আমরা শিক্ষা নিয়ে স্বাস্থ্যখাতকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে না পারি তবে বাংলাদেশ এক অজানা গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাবে।
কি ধরনের স্বাস্থ্য বাজেট জরুরি
করোনায় আমরা যে শিক্ষা পেলাম তাতে করে এটা পরিষ্কার যে আমাদের দেশের স্বাস্থ্যখাত বেসরকারী মুনাফাকেন্দ্রিক খাতে পরিনত হয়েছে। এখানে সরকারীভাবে সাধারণ মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা সেভাবে পৌঁছে না। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সার্বজনীন বলা হলেও মোট স্বাস্থ্য খরচের ৭৪ শতাংশই সাধারণ মানুষকে তার নিজের পকেট থেকে খরচ করতে হয়। এই পরিসংখ্যানই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, স্বাস্থ্যসেবা প্রান্তিক পর্যায়ে বিনামূল্যে/স্বল্পমূল্যে পৌঁছানোই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যদি করোনার থেকে বাঁচতে হয় তবে সবার আগে এই দিকটি বিবেচনা করতে হবে। স্বাস্থ্য বাজেটে সেবা পৌঁছে দেয়া সংক্রান্ত দিকেই সর্বাধিক বেশি মনোযোগ দিতে হবে।
আগামী স্বাস্থ্য বাজেটকে অতি অবশ্য সামগ্রিক বাজেটের কেন্দ্রবিন্দু হতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। করোনা বিস্তারের পরে বৃহৎ হাসপাতাল দিয়ে আমাদের সেরকম বড় কোন লাভ হবে না। বরং কম সংক্রমণ মাত্রা রাখার জন্য যাবতীয় যা কিছু করতে হবে এবং স্বাস্থ্য বাজেটে এসবকেই গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। লক ডাউন করে কিভাবে বেশি সংক্রমিত অঞ্চলে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা যায় সেরকম পদক্ষেপে গুরুত্ব দিতে হবে। যা ভিয়েতনামসহ বেশ কিছু দেশে দেখা গেছে। তাদের থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
অবকাঠামো নির্মানের ক্ষেত্রে তিন/চার ভাগে বিভক্ত করে পরিকল্পনা এবং বরাদ্দ দিতে হবে। এক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদী এবং করোনা মোকাবেলায় জরুরি দিকগুলোকে প্রাধান্যে রাখতে হবে। যেমন, হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ, ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন সিলিণ্ডার সরবরাহ করার ক্ষেত্রে বেশি খরচ করতে হবে।
সাথে সাথে সামনের দিনে ভ্যাক্সিন সহজলভ্য হলে সেটা কিভাবে সরকারি খরচে সকল জনগণের কাছে পৌঁছানো যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে গবেষণা খাতে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে বরাদ্দ আরো বাড়াতে হবে।দ্রুত পরীক্ষণ, কারিগরি ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ এবং বিশেষত ল্যাবরেটরী নির্মাণ এবং সেসবকে মানোন্নয়নের দিকে নজর দিতে হবে।
নতুন ডাক্তার, নার্সদের নিয়োগ এবং বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে নিয়োগের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে করোনার সময়ে কিছু নিয়োগ দেয়া হলেও গড় জনসংখ্যার অনুপাতে ডাক্তার এবং নার্সের সংখ্যা এখনো অপ্রতুল।
শ্রমিকদের জন্য দেয়া ৫০০০ কোটি টাকার প্রণোদনায় তেমন কোনো লাভ শ্রমিকদের হয়নি। দেশ রূপান্তর সহ সব পত্রিকাতেই শ্রমিকদের বকেয়া বেতনের খবর আসছে। রুবানা হক জুন মাস থেকেই শ্রমিক ছাঁটাই এর ঘোষণা দিয়েছে। কৃষি প্রণোদনাও এখনো পর্যন্ত লোপাটের খাতাতেই। ফলে শুধু বৃহৎ বাজেট দেয়াই মূল ব্যাপার নয়। মূল ব্যাপার হলো কাজের দিকে খেয়াল রাখা।করোনার মধ্যেই চিকিৎসা যন্ত্রাংশ কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বাজেটে লুটপাট যেন না হয় সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। সরকারদলীয় লোকজনের লুটপাটকে কঠোরভাবে মোকাবেলা না করা গেলে মেগা বাজেট দিয়েও তেমন কোন কাজ হবে না।
মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বাস্থ্যকে বিবেচনা করতে হবে
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ব্যবসায়িক খাত থেকে জনবান্ধব খাতে পরিণত করতে হবে। করোনা প্রমাণ করেছে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মূলত মুনাফাকেন্দ্রিক ভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে রয়েছে চিকিৎসা ব্যবস্থা। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্যের অধিকার হলেও বাংলাদেশের সংবিধানেই এই অধিকার সুরক্ষার কোন বক্তব্য নেই। নামমূল্যে মৌলিক নাগরিক অধিকারের কিছুটা স্বীকৃতি দেয়া হলেও কিভাবে এই অধিকার রক্ষিত হবে তার কোন ব্যাখ্যা নেই। এদিকে কেউ যদি স্বাস্থ্য সুরক্ষা না পান সেক্ষেত্রে তিনি চলমান আইনের দ্বারস্থ্য হতে পারবেন না। কারণ সংবিধানেই এমন কোন বিষয় যুক্ত নেই যে, স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিতে রাষ্ট্র ব্যর্থ হলে বিচার বিভাগ দ্বারা কোন নাগরিক চাপ প্রয়োগ করতে পারবে। অর্থাৎ স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে কোনভাবেই সরাসরি মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতিই দেশে নেই।
স্বাস্থ্য খাত নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের জোরের সঙ্গে বলতে হবে যে, স্বাস্থ্য নীতি এবং পরিকল্পনাসমূকে জনবান্ধব হতে হবে। রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। নতুবা আমরা কোনভাবেই করোনা থেকে নিস্তার পাবো না।
লেখক : রাজনৈতিক কর্মী