কাকন রেজা :
ডেইলি স্টার একটি রিপোর্ট করেছে একজন ডাক্তারকে উদ্ধৃত করে। যিনি নিজে কোভিড রোগীদের চিকিৎসা করছেন। তার বাবা একজন কোভিড পেশেন্ট। তার বাবার এক্সরে রিপোর্ট খারাপ। ফুসফুস পানিতে ভরে গেছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া দরকার। কিন্তু সিট নেই। সে বাবার রিপোর্ট দেখে, বাবাকে তার চেম্বারের বাইরে বসতে বললেন। তারপর, নিজে কাঁদলেন ঝরঝর করে।
এই চিত্রটাকে তুলতে ধরতেই ডেইলি স্টারের শিরোনাম ছিলো, ‘A doctor finds her father as patient, in bad shape’, এই bad shape শুধু সে ডাক্তারের বাবার ফুসফুসের নয়, এই bad shape পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থারই। দুই মাস আগেই লিখেছিলাম, এখনও সময় আছে ব্যবস্থা নিন। না হলে যারা চিন্তা করছেন, অর্থ আর ক্ষমতা রয়েছে আইসিইউ বেড পেয়ে যাবেন, এমন চিন্তা বোকামির। কি এখন মনে হচ্ছে না চিন্তাটা বোকামির? এই যে গণমাধ্যমের শিরোনাম, ‘চার হাসপাতাল ঘুরে আইসিইউ না পেয়ে মারা গেলেন কোটিপতি’, তাকি সেই বোকামিই প্রমান করে না? বলেছিলাম, অর্থ, প্রভাব আর প্রতিপত্তি কোনটাই খাটবে না। খেটেছে? এই bad shape এর কথা তখন কেউ কানে তুলেননি। এখন যিনি বলছেন, ‘সামনে মহাবিপদ’। সেদিন তিনিই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিলেন কোভিডকে। এখন যখন দুয়ারে দাঁড়ানো পালকি, তখন বুঝলেন যেতে হবে।
দেখুন, যেতে হবে জেনেও মানুষের লোভের সীমা-পরিসীমা নেই। এ বছরের ১৪ মে যুক্তরাষ্রেও র গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েল এক্স’ এর পরিসংখ্যান মতে দ্রুত ধনী হওয়া ব্যক্তির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। চিন্তা করুনতো অবস্থা। যে দেশে মহামারিতে একজন চিকিৎসক আইসিইউ ‘দূর কা বাত’ শুধু অক্সিজেনের অভাবে মারা যায়। চিকিৎসকের পিতা হাসপাতালে সিট পায় না। সাধারণ মানুষ হাসপাতালের গেইটে দম ছেড়ে দেয়। রাস্তায়, রেল স্টেশনে মৃতদেহ পড়ে থাকে। সেই দেশের কিছু ব্যক্তি দ্রুত ধনী হবার দৌড়ে বিশ্বে প্রথম! কতটা বিচিত্র এই সমীকরণ, বুঝতে পারেন আপনারা! কতটা আজব, কতটা অদ্ভুত তা-কি আপনাদের বোধে-বুদ্ধিতে ধরে!
ওহ, কতটা হলে ‘ওয়েল এক্স’ এর মতে ধনী বলা হয় সেটাতো বলা হলো না। সংস্থাটির পরিমাপে যাদের সম্পদের পরিমান ৫০ লাখ ডলারের বেশি তারাই ধনীর তালিকায় ঠাঁই পান। অর্থাৎ আমাদের দ্রুত ধনী হওয়া ব্যক্তিগণ এই পরিমান বা এরও অনেক বেশি সম্পদের মালিক। কেন হবে না। প্রথম আলোর সিকদার পরিবার নিয়ে করা এক প্রতিবেদনে সারা বিশ্বে তাদের যে সম্পদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তাতে না হবার তো কিছু নেই। যে দেশ থেকে লক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়ে যাবার পরিসংখ্যান উঠে আসে, সেখানে সবই সম্ভব। জানি না, একেও আমাদের কথিত উন্নতির নজির হিসাবে দেখানো হয় কিনা। আলেকজান্ডারের বিচিত্র এই দেশে সবই সম্ভব।
হ্যাঁ, অনেকেই বলেন, সম্ভব সম্ভবের দেশ। অবশ্যই সম্ভব সম্ভবের দেশ আমাদের এই দেশটি। এ দেশে কী নেই। খনিজ, প্রাণিজ সকল সম্পদ রয়েছে দেশটিতে। রয়েছে উর্বর জমি। রয়েছে মানব সম্পদ। চীন যে সম্পদের বলে আজকে সারা দুনিয়ায় রাজত্ব করতে যাচ্ছে। অথচ সেই মানব সম্পদকে আমরা কাজে লাগাচ্ছি না সঠিক পন্থায়। আমাদের খনিজ সম্পদের সঠিক ব্যবহার করতে পারছি না। বলতে পারেন করতে দেয়া হচ্ছে না। দ্রুত ধনী হবার দৌড়ে লিপ্ত কিছু মানুষের কাছে আমাদের আমজনতার চাওয়া-পাওয়া মার খাচ্ছে। আর আমাদের এক শ্রেণির সুশীল বেকুব পড়ে রয়েছেন তর্ক বিদ্যা নিয়ে। তত্ত্ব তালাশে দিন কাটাচ্ছেন তারা। বাড়াচ্ছেন বিভক্তি মানুষের মাঝে।
মূলত এই কথিত তাত্বি মক শ্রেণিই ধনী হবার দৌড়ে থাকা মাফিয়াতন্ত্র উত্থানের জন্য দায়ি। এরা মানুষকে ভাগ করে দিয়েছে নানান তরিকায়। এরা সামান্য এক ডাক্তারের দেশে আসা নিয়ে তর্কের নামে লঙ্কাকান্ড বাধায়। এরা একটা হাতি বা পাখির মৃত্যু নিয়ে পারে তো ভার্চ্যুয়াল মিছিল নামিয়ে দেয়। অথচ রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষের লাশ এদের কোনো বোধ জাগায় না। এরা অ্যামেরিকার রেসিজমের বিরুদ্ধে দেশে ঘোট পাকায়। জর্জ ফ্লয়েডের জ্ঞাতি ভাই হয়ে উঠে। কিন্তু নিখিল, মমিনুল’রা এদের চিন্তায় নাড়া দেয় না। আপন ভাই, সন্তানের মৃত্যুকে তারা সৃষ্টিকর্তার দায়ে ছেড়ে দেয়, আর অন্য দেশের প্রতিকি কফিন কাঁধে নেয়। এমন কিম্ভুত তাত্বিকাক আর তত্বেআরর সমাহার যে দেশে, সে দেশের shape তো bad হবেই।
আমার গত হওয়া সাংবাদিক ও সাহিত্যিক পিতা বলেছিলেন, ‘যে দেশে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা হয়, সে দেশে আমাদের সকলই পন্ডশ্রম।’ বাবার শেষ উপলব্ধিটাকে এই মহামারির সময়ে এসে নিঠুর সত্য বলে মনে হয়। যখন দেখি, মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও মানুষ ব্যবসা করতে ছাড়ে না। পাঁচ হাজার টাকার অক্সিজেন উঠে পঁচিশ হাজারে। দশ টাকার মাস্ক বিক্রি হয় এক’শ টাকায়। বাজার থেকে ওষুধ হাওয়া হয়ে যায়। সফ্টওয়্যার কেনার নামে কোটি কোটি টাকা লোপাট করার ধান্ধা হয়। এমন একটা অবস্থায় আমাদের সকল শ্রম পন্ড হওয়াই তো সঙ্গত। সাথে `bad shape’ টা আমাদের নিয়তি হয়ে উঠা!
লেখক : কাকন রেজা, সাংবাদিক ও কলাম লেখক।