দেশে প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে চলার মধ্যেই জোনভিত্তিক লকডাউন বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে সরকার। সংক্রমিতের হার বিবেচনায় তিনটি জোনে বিভক্ত করে সরকার লকডাউন কার্যকর করতে চায় বলে ইতোমধ্যে জানিয়েছেন জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তবে এ নিয়ে বিভ্রান্তি বেড়েই চলেছে।
গত সপ্তাহে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজার এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে জোনভিত্তিক কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর থেকে সবার মনে প্রশ্ন জাগে, সারাদেশে কবে নাগাদ এই কার্যক্রম শুরু হবে? গতকাল ১৪ জুন, রবিবার পর্যন্ত জোনভিত্তিক কার্যক্রমের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি স্বাস্থ্য বিভাগ। তবে ইতোমধ্যে ইতিমধ্যে রেড, ইয়েলো ও গ্রিন জোনে কীভাবে কাজ হবে সেজন্য একটি গাইডলাইন প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্য বিভাগের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না আসলেও বিভিন্ন পত্রিকা, অনলাইন, টেলিভিশনসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জোনভিত্তিক ভাগের খবর প্রকাশিত ও প্রচারিত হচ্ছে। জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির উদ্ধৃতি দিয়ে রেড জোনের তালিকাও প্রকাশ করেছে বেশ কিছু গণমাধ্যম। তবে এ ধরনের খবরকে ভিত্তিহীন বলে আখ্যায়িত করেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ও ফোকাল পারসন হাবিবুর রহমান খান।
জোনভিত্তিক তালিকা এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি উল্লেখ করে একটি জাতীয় দৈনিকে তিনি পাল্টা প্রশ্ন তোলেন, ‘ওইসব গণমাধ্যম কিভাবে তালিকা পেল?’ তবে তিনি জানান, তালিকা তৈরির কাজ চলছে।
করোনা প্রতিরোধে সরকার যে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি গঠন করেছে, তার উদ্ধৃতি দিয়ে গণমাধ্যমে জোনভিত্তিক কার্যক্রমের তথ্য প্রকাশ হচ্ছে। তবে জোনভিত্তিক কোনো তালিকা তারা প্রকাশ করেননি বলে জানিয়েছেন এই কমিটির সদস্য সচিব জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। তিনি বলেন, ‘এমন তালিকা আমাদের হাতে পৌঁছায়নি।’
এদিকে রেড, ইয়েলো ও গ্রিন জোন ভাগ করা এলাকাগুলোর পূর্ণাঙ্গ তালিকা একসঙ্গে প্রকাশ করা হবে না বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র। তারা জানায়, যখন যেসব এলাকা লকডাউন করা হবে, তখনই সেইসব এলাকার নাম প্রকাশ করা হবে।
সার্বিক বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘রাজাবাজারসহ কয়েকটি এলাকার মধ্য দিয়ে জোনভিত্তিক পরীক্ষামূলক লকডাউন আগেই শুরু হয়ে গেছে। অনেকে বিষয়টি না বুঝে জোনভিত্তিক লকডাউন শুরু হতে যাচ্ছে বলে প্রচার করছেন।’
জোনভিত্তিক এলাকাসমূহের একটি তালিকা অবশ্যই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘কিন্তু তা জনসম্মুখে প্রকাশ করার বিষয় নয়।’
লকডাউন বাস্তবায়নকারী কমিটি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাই আগে থেকে তালিকার বিষয়ে জানার এখতিয়ার রাখেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
চলমান লকডাউন প্রক্রিয়ায় প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা রেড জোনে অন্তর্ভুক্ত হবে, আবার সংক্রমণরোধে উন্নতি ঘটিয়ে রেড জোন থেকে মুক্তি পাবে উল্লেখ করে মহাপরিচালক আরো বলেন, ‘তাই একটি এলাকাকে বেশি সময়ের জন্য রেড জোনে রাখা যেমন ঠিক হবে না, তেমন সংক্রমণের হার বেড়ে গেলে একটি এলাকাকে বেশি দিন ধরে ইয়েলো জোনে রাখাও ঠিক নয়।’
‘জোনভিত্তিক লকডাউনের বিষয়টি অনেকটা পরিবর্তনশীল। কোনো এলাকার করোনা পরিস্থিতির অবনতি সেটি এমনিতেই রেড জোনে যুক্ত হয়ে যাবে। আর রেড জোনের পরিস্থিতির উন্নতি ঘটালে চলে যাবে ইয়েলো ও পরবর্তীতে গ্রিন জোনে’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘জোনভিত্তিক লকডাউনের পাইলটিংয়ের মাধ্যমে অনেক কিছু শিক্ষা পাচ্ছি। লকডাউন কার্যকর করার আগে খুব কম সময় পাবেন লকডাউন এলাকার বাসিন্দারা। তবে লকডাউন কার্যকর করার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কমিটি ও প্রতিষ্ঠানসমূহকে বিষয়টি কয়েকদিন আগেই জানানো হবে, যাতে তারা ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে পারেন।’
লকডাউন দেওয়ার অনেক আগে থেকে জানানোর অভিজ্ঞতা ভালো না উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘লকডাউন এলাকার মানুষ অন্য এলাকায় চলে গেলে লকডাউন দেওয়ার উদ্দেশ্য সফল হবে না। তাছাড়া লকডাউন চলাকালেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহে সমস্যায় পড়তে হবে না এলাকাবাসীর। লকডাউন বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত কমিটি, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের এলাকাবাসীর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহসহ সমস্যাসমূহ সমাধান করার জন্য প্রস্তুত থাকবেন।’
করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে গঠিত এলাকাভিত্তিক কমিটি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ রেড জোনে তালিকাভুক্ত করার জন্য কোনো এলাকার নাম প্রস্তাব করলে তা দ্রুততম সময়ের মধ্যে পর্যালোচনা করে বাস্তবভিত্তিক হলে লকডাউনের জন্য তালিকাভুক্ত করা হবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে সরকার মূলত জোনভিত্তিক লকডাউনের মাধ্যমে করোনা মোকাবিলার কৌশল গ্রহণ করেছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। গতকাল তিনি বলেন, ‘সেই কৌশলে রেড জোন চিহ্নিত এলাকায় লকডাউন ও সাধারণ ছুটি থাকবে। এছাড়া আগের শর্তেই সরকারের দেওয়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন ও সরকারি-বেসরকারি অফিস চলবে।’
তিনি বলেন, ‘জোনিং করে লকডাউন, এটা খুবই একটা কার্যকর ব্যবস্থা বলে আমরা মনে করছি। একইসঙ্গে চার-পাঁচটি স্থান রেডজোন ঘোষণা করে লকডাউন বাস্তবায়ন করা হতে পারে।’
রাজাবাজারে যে পরীক্ষামূলক লকডাউন চলছে সেখানকার ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলোকে সংশোধন করা হবে বলেও জানান প্রতিমন্ত্রী।
তিনি আরো বলেন, ‘একটি স্থানকে শুধু লকডাউন করলেই চলবে না। সেখানে বসবাসকারী মানুষের জন্য আমাদের কিছু দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে, এগুলো নিশ্চিত করতে হবে।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, মোবাইল নম্বরের মাধ্যমে রোগী চিহ্নিত করার পর যেসব এলাকায় সবচেয়ে বেশি রোগীর অবস্থান শনাক্ত হবে সে এলাকাকে ‘রেড জোন’ ঘোষণা দিয়ে ওই এলাকা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পুরোপুরি লকডাউন করে দেওয়া হবে। লকডাউন করা ‘রেড জোন’ এর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত কাউকেই ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হবে না।
একই পদ্ধতিতে চিহ্নিত করা হবে ইয়েলো ও গ্রিন জোন। এরপর প্রয়োজনে এই কড়া লকডাউনের আওতায় আসবে ‘ইয়েলো জোন’ও। তবে ‘ইয়েলো জোন’ থেকে খুব জরুরি প্রয়োজন পড়লে ঘর থেকে বের হওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করে ঢাকাসহ সারা দেশের বড় বড় শহর থেকে শুরু করে একেবারে গ্রাম পর্যন্ত প্রায় সব এলাকায় প্রতিদিন শনাক্ত হওয়া আক্রান্তদের মোবাইল নম্বর চিহ্নিত করে ওইসব এলাকার ম্যাপ তৈরি করছেন বিশেষজ্ঞ কমিটি। এভাবে রাজধানীর আক্রান্তদের অবস্থান শনাক্ত করার এ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এখন চলছে দেশের অন্যান্য এলাকায় তাদের অবস্থান চিহ্নিত করার কাজ।
অপর একটি সূত্রে জানা গেছে, জোনভিত্তিক কার্যক্রম নিয়ে গতকাল রাতে একটি ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধি ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নিয়েছেন।
বাংলা/এসএ/