কাকন রেজা :
আমাদের দেশের মানুষের ‘আজাইরা’ আলাপে সময়ের অভাব হয় না। কাজের আলাপেই যত সমস্যা। করোনাকালে মানুষের মৃত্যু, আক্রান্ত এসব শুনতে শুনতে মাথা খারাপ হবার জোগার। ছোট-বড় কেউ রেহাই পাচ্ছেন না। গরীব-ধনী, ক্ষমতাবান-হীন সবাই যোগ দিচ্ছেন মৃত্যুর মিছিলে। এ অবস্থায় একপক্ষ আলাপ শুরু করলেন মাসুদ রানা’র মালিকানা নিয়ে। একজন দাবী করলেন মাসুদ রানার অনেক বই তার লেখা আর সেটা নিয়ে পড়িমরি করে নেমে পড়লেন সকলে।
আরেক পক্ষ লাগলেন বহিষ্কার নিয়ে। আরে ভ্রাতাগণ এখন মূর্তি গড়ার সময় নয়। এখন ভাবের মূর্তি গড়ে উঠতে পারে কিংবা পুনঃনির্মিত হতে পারে একমাত্র মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেয়ার মধ্যে। হাইকোর্ট বলেছেন, ‘হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেলে সেটা ফৌজদারী অপরাধের পর্যায়ে।’ শুধু তাই নয়, এ বিষয়ে রুল জারি করে দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এই অবস্থায় অন্যসব আলাপ যে আপাত কম গুরুত্বপূর্ণ কিংবা গুরুত্বহীন তা বোঝার ক্ষমতা অনেকেই হারাতে বসেছেন।
কদিন আগে ভারতের কেরালায় হাতির মৃত্যু নিয়ে চললো ‘আজাইরা’ আলাপ। একপাল রীতিমত পশুপ্রেমী হয়ে উঠলেন। তাদের আহাজারিতে গণ ও সামাজিকমাধ্যম ভেসে যাওয়ার অবস্থা। এরপর পড়লেন পাখি নিয়ে। পাখিকে মারা হয়েছে ডিমগুলোর কী হবে, এনিয়ে রীতিমত হাইপোথিসিস শুরু হলো। এখন চলছে ভারতীয় এক অভিনেতার আত্মহত্যা নিয়ে। আশ্চর্য রকম হা-হুতাশনের প্রতিযোগিতা দেখতে পাবেন সামাজিকমাধ্যমে। গণমাধ্যমই বা পিছিয়ে থাকবে কেন, তারাও সেই আত্মহত্যার পোস্টমর্টেম শুরু করে দিয়েছে। অথচ আজকে যখন লিখছি তখন করোনার মৃত্যু পরিসংখ্যানে যোগ হয়েছেন আরো আটত্রিশ জন মানবসন্তানের নাম। এই মৃত্যুর জন্য তাদের হা-হুতাশ নেই। আছেন ভারতীয় অভিনেতার আত্মহত্যা নিয়ে। আলেকজান্ডার এমনিতেই বিচিত্র বলেননি দেশটিকে।
গত ৯ জুন যুগান্তরের একটি খবরের শিরোনাম ছিলো, ‘না’গঞ্জে কিস্তি পরিশোধের চাপ এনজিওর, ৩ সন্তানের জননীর আত্মহত্যা।’ জানি না ভারতীয় অভিনেতার আত্মহত্যার দুঃখে রোদনাক্রান্তদের এই খবরটি চোখে পড়েছে কিনা। হয়তো পড়েনি। পড়লেও সাধারণ জননীর মৃত্যু তাদের অনুভূতিকে আহত করতে পারেনি। আমাদের এখানে আবার অনুভূতি আহতের নানান রকম রয়েছে। তাদের রকমের সাথে হয়তো তিন সন্তানের মা’র আত্মহত্যা ম্যাচ হয়নি। বড় বিচিত্র এই ম্যাচ আর মিসম্যাচের অনুভূতিময় খেলা।
করোনাকালে তিনটা সন্তান রেখে একজন মা কতটা অসহায় হলে আত্মহনরের পথ বেছে নেন, তাকি ভেবে দেখেছেন কেউ। দেখেননি। দেখলে এমনটা ঘটতো না। এনজিওয়ালাদের লাগাম টেনে ধরতেন। এটাও এক ধরনের হত্যাকাণ্ড। আত্মহননে প্ররোচিত করা শুধু নয় বাধ্য করা। এটা নিশ্চিত ফৌজদারী অপরাধ। আত্মহত্যার কারণ সম্পর্কে খবরে জানানো হয়েছে, আত্মহননের শিকার ওই নারীর স্বামী মালয়েশিয়ায় থাকেন। লকডাউনের কারণে তিনমাস সে টাকা পাঠাতে পারেনি। এর মধ্যে এনজিওয়ালাদের চাপ। যে চাপ মানসিক ভাবে নেয়া সম্ভব ছিলো না সেই মায়ের পক্ষে, তাই আত্মহননের পথ বেছে নেন তিনি।
এই মৃত্যুও করোনার জন্য, লকডাউনের জন্য। যারা ঘরে বসে আরামে খাচ্ছেন, তাদের লকডাউনের ধকল গায়ে লাগছে না। তাদের ঘরে খাবারের অভাব পড়ছে না। কারো তো ‘খুশি জলের’ও অভাব নেই। তাই তাদের নানা রকম ‘খাজুরা’ আলাপ বের হয়। ঘরে বাসে লাইভ করেন, করোনাকালে কী করতে হবে। উপদেশ দেন, স্বাস্থ্যকর খাবার খান, সবুজ শাকসব্জি-ফলমূল খান। কিন্তু খাবার কোথা থেকে আসবে তা বাতলিয়ে দেন না। বলিহারি তাদের।
সত্যি মেজাজ খারাপ হয়। প্রতিটা মানুষ যাচ্ছে এক ধরনের ট্রমা’র মধ্যে দিয়ে, মানসিক ট্রমা। আমি নিজেও এর বাইরে নই। প্রায় তিনমাস হলো সারাদেশ থমকে আছে। চলছে তো চলছে না। শ্রমিক ছাটাই হচ্ছে। পোশাক কারখানার মালিকরা ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন ছাঁটাইয়ের। ছাঁটাই হবে এটা নিশ্চিত। কিন্তু ছাঁটাইয়ের পর এই শ্রমিকগুলোর কী হবে? তাদের বিকল্প কর্মসংস্থান কী? এই প্রশ্নগুলো এখন জ্বাজল্যমান, অথচ এর কোনো সম্ভাব্য উত্তর জানা নেই। আসলে আমাদের একটা শ্রেণির কোনো উত্তরই জানা নেই, জানার ইচ্ছাও নেই। তারা শুধু জানার ভান করে। এরাই ‘সহমত’ গ্রুপ। ‘আজাইরা’ আর ‘খাজুরা’ আলাপের পাল। এদের জন্য সত্যিই করুণা হয়।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আপনার মন্তব্য লিখুন